শরীফ ইকবাল রাসেল, নরসিংদী:প্রতিটি মানুষেরই স্বচ্ছল জীবন যাপনের একটি স্বপ্ন থাকে। আর এই স্বচ্ছল জীবন যাপনের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে। স্বামীর একক উপার্জনে যখন সংসার চালানো হিমশিম খাচ্ছিল। তখনই কামরুন নেছার মাথায় আসে নিজে কিছু করার। তিনি সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোক্তা হওয়ার।
সেই চিন্তায় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে শহরের উপজেলা মোড়ে ভাড়া বাসার একটি কক্ষে ২০১০ সালে শুরু করেন নূহা বিউটি পার্লার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে ঢাকা থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মনোনিবেশ করেন কাজে। এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিমাসে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করতে থাকেন। এভাবে দক্ষতা আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তার আয় থেকে তিনি গড়ে তোলেন ‘নহর বুটিক’ ও ‘নবরঙ’ নামে আরো দুটি বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠান। ফলশ্রুতিতে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নরসিংদী জেলা নারী উদ্যোক্তা কাউন্সিল (নাসিব) এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনসহ বিভিন্ন কারনে ঘরবন্দী মানুষ। সরকারি নিয়ম মানতে গিয়ে কামরুন নেছার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। একদিকে মাস গেলে বাসাভাড়া, অন্যদিকে পরিবারের ভরণপোষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। ভেবে চিন্তে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ফেইজবুকে ‘নুহা বিউটি পার্লার’ নামে একটি পেজ খোলেন। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় করোনার এই মহামারিতে অনলাইনে ব্যবসার কথা চিন্তুা করে ‘নহর বুটিক’ নামে আরো একটি পেজ খোলে ব্যবসা শুরু করেন। লকডাউনে সরকারি নির্দেশনায় বাস্তবিক অর্থে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও অনলাইনে তিনি ব্যবসায় সফল একজন উদ্যোক্তা।
ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মেধাবী একজন মানুষ। যার ফলে দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করেন। শিক্ষা জীবন শেষে সরকারি চাকরির দিকে না তাকিয়ে ২০০৫-২০০৬ সালে দুই বছর মেয়াদে পর্যটন কর্পোরেশন (এনএইচটিটিআই) থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা ইন হোটেল ম্যানেজম্যান্ট এর ওপর একটি কোর্স সম্পন্ন করেন।
২০০৭ সালে ‘হোটেল ওয়েস্টিন’ এ শেফ হিসেবে যোগদান করেন। এর সঙ্গে যোগ হলেন বাংলাদেশে প্রথম মহিলা শেফ হিসেবে। কিছুদিনের মধ্যেই দেশের ফাইভস্টার হোটেলের জগতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি হলেন ফাহেমা ইসলাম মেরী।
প্রায় সাড়ে ৮ বছর চাকরি শেষে ছেলে-মেয়ের ভরণ-পোষণ ও তাদের শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নরসিংদী শহরের বাগদি মহল্লায় বাবার বাসায় চলে আসেন। দু-বছর বাবার বাসায় থেকে পাশের একটি ভাড়া বাসায় উঠেন তিনি। এখানে আসার পর আয়ের বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে যান।
এভাবে একদিন চিন্তা করে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘স্পাইস এন্ড ট্রিট’ নামে একটি পেজ খোলেন। চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি বাসায় তৈরি করেন ৭৫ প্রকারের মসলা। যা ভেজামুক্ত, নিরাপদ ও বিশুদ্ধ মসলা হিসেবে স্বীকৃত।
অনলাইনে তার তৈরি মসলার দরদাম, তৈরির বিবরণ ও কার্যকারিতা তুলে ধরা হলে কিছুদিনের মধ্যেই তার তৈরি মসলা ভারত, নেপাল ও মালয়শিয়া সহ সারাদেশে রফতানি শুরু হয়। মাত্র ৩ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসার শুরুটা হলেও মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে আজ ব্যবসার মূলধন দুই লাখ টাকা। এরফলে তিনি অর্জন করেন জার্মান প্রেসিডেন্ট ও মালয়েশিয়ার ফার্স্টলেডির থ্যাঙ্কস লেটারও। সরকারি ও বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা পেলে তিনি আরো অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
পেশায় বেসরকারী স্কুলের শিক্ষিকা। স্কুলের বেতন দিয়ে সুন্দর মতোই চলছিল সংসার। কিন্তু করোনার হানায় বন্ধ হয়ে যায় স্কুলটি। স্কুল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে দু-চারমাস বেতন দেয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। আর্থিক সমস্যায় পরে যান তিনি। এই অবস্থায় আয়ের পথ তৈরীর আশায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেইজবুকে ‘সাবরিনা’স কালেকশন’ নামে একটি পেজ খোলেন তিনি। এতোক্ষন যার কথা বলা হচ্ছে তিনি হলেন শহরের সাটিরপাড়া মহল্লার ওমর ফারুকের স্ত্রী সাবরিনা সরকার।
করোনা পরিস্থিতিতে পেইজে নিয়মিত পোস্ট ও শেয়ার করে সফলতার মুখ দেখেন সাবরিনা। জামদানি শাড়ি, থ্রি পিস, ওয়ান পিস নিয়ে তার এক বিশাল কালেকশন। আর নিয়মিত পোস্টের মাধ্যমে নিজের পেজ ও গ্রুপ থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক সারা পান তিনি। মাত্র এক মাসের মধ্যেই ‘উই’ এর লাখপতির খাতায় নাম আসে সাবরিনার।
প্রথমে খুচরা হিসেবে বিক্রি করলেও এখন সাবরিনা’স কালেকশন এবং ‘উই’ গ্রুপে জামদানি পণ্য হোলসেল করেন এই উদ্যোক্তা।
সাবরিনা সরকার তার অদম্য ইচ্ছা, সততা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তার উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতাও পেয়েছেন তিনি।
বর্তমান প্রতিযোগিতার যুগে শুধু চাকরির আশায় না থেকে নিজের মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে তথ্য প্রযুক্তির সহযোগতায় উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশীয় পণ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার আহবান জানান সাবরিনা সরকার।
সুমি আক্তার একজন নাম থেকে একটি প্রতিষ্ঠান। একান্ত ইচ্ছা আর চেষ্টায় আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত। বাসা নরসিংদী শহরের দাসপাড়া মহল্লায়। বাবা মায়ের সংসারে নিজে টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। পরবর্তীতে সরকারি চাকরির দিকে না তাকিয়ে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতর থেকে ২০১৬ সালে পোশাক তৈরির ওপর একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কমপিউটার, ব্লক বাটিক, হস্তশিল্পসহ কয়েকটি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি শহরের পূর্ব ভেলানগর মানিক রোডে একটি প্রশিক্ষণ একাডেমি গড়ে তুলেন। পাশাপাশি সাপোর্ট ইউথ অ্যান্ড ওমেন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
এই প্রশিক্ষনের মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পার হতে না হতেই করোনার হানার শিকারে পরিণত হন। বন্ধ রাখতে হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। এই পরিস্থিতিতে অফিসের ভাড়াসহ পারিবারিক ভরণপোষনে আর্থিক দৈন্যদশা দেখা দেয়। এই অবস্থায় নিজস্ব মোবাইল ব্যবহার করে ফেউজবুকে ‘রুপকথার হস্তশিল্প’ নামে একটি পেইজ খোলেন। এই পেইজ ব্যবহার করে নিজস্ব তৈরি পোশাক সহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের ছবি তুলে ধরেন। অল্প সময়ের মধ্যেই সাড়া পান এই অনলাইনের ব্যবসায়। করোনাকে কেন্দ্র করে তার এই ব্যবসায় অনেকটা বেশিই বেচাকেনা হচ্ছে। সুমি আক্তারের দাবি কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেলে অনলাইনকে ব্যবহার করে ঘরে থেকেই লাখ টাকা আয় করতে পারেন নারীরা।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্যমতে, এখন দেশে ফেসবুক পেজকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তা আছেন চার লাখের ওপরে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। নারী উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই গৃহিণী। ই-কর্মাস এখন একটি জনপ্রিয় খাত। দিনদিন এর চাহিদা বাড়ছে। এখন পর্যন্ত ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এই করোনাকালে লকডাউন থাকলেও ব্যবসা করতে পেরেছেন অনলাইন ব্যবসায়ীরা। অনলাইনে পণ্য বিক্রি নারীদের কাজের সুযোগ তৈরিতে ভালো অবদান রাখছে। এ বিষয়ে বুঝে শোনে সময় দিলে ভালো করার সম্ভাবনা আছে।
Leave a Reply